অস্ট্রেলিয়া একটি অতি বৈচিত্র্যময় দেশ, যার ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং সমাজের বহুবিধ উপাদানকে প্রতিফলিত করতে এটি তিনটি পৃথক পতাকা প্রদর্শন করে। একাধিক পতাকা উড়ানোর এই প্রথা অনেকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়, বিশেষ করে যারা প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার সরকারি স্থানগুলোতে গিয়ে এটি লক্ষ্য করেন। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের চত্বরটি পরিদর্শন করার সময়, পাঁচটি পতাকা উড়তে দেখে আমারও এই বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পতাকা, এবং অন্যান্য তিনটি পতাকা ছিল, যা দেখে মনে হয়েছিল—এগুলি কেন ওড়ানো হচ্ছে এবং এদের প্রতিটির ব্যাখ্যা কী?
অস্ট্রেলিয়ার মূল জাতীয় পতাকা সম্পর্কে সবাই জানেন। এটি অস্ট্রেলিয়ার ব্রিটিশ উপনিবেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। পতাকার বাঁ পাশে রয়েছে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক, যা যুক্তরাজ্যের পতাকার একটি অংশ। এর নিচে একটি সাত কোণবিশিষ্ট কমনওয়েলথ স্টার রয়েছে, যা অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেশনকে প্রতিফলিত করে। এছাড়া, এই পতাকায় সাউদার্ন ক্রস নামক পাঁচটি উজ্জ্বল নক্ষত্রও রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা এই নক্ষত্রগুলির দিকে নির্দেশ রেখে অস্ট্রেলিয়ার দিকে রওনা দিতেন। তাই, এই পাঁচটি নক্ষত্রের প্রাধান্য অস্ট্রেলিয়ার সবার কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে অস্ট্রেলিয়ার পতাকাগুলির মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ন পতাকা রয়েছে, যা বিশেষভাবে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো এই পতাকা অ্যাডিলেডের ভিক্টোরিয়া স্কয়ারে উড়ানো হয় এবং ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার সরকার এটি দাপ্তরিক স্বীকৃতি দেয়। এই পতাকার উপরের অংশ কালো, যা আদিবাসী জনগণের অস্তিত্ব এবং তাদের সংগ্রামকে চিহ্নিত করে। পতাকার নিচের অংশ লাল, যা পৃথিবীর মাটির রং, এবং মাঝখানে হলুদ একটি বৃত্ত রয়েছে, যা সূর্যকে প্রতিফলিত করে। এই পতাকা আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের সংগ্রাম, ঐতিহ্য এবং পরিচয়কে তুলে ধরে এবং অস্ট্রেলিয়ার ভূগোল ও সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তাদের গুরুত্ব এবং অবদানকে সম্মান জানায়।
তৃতীয় পতাকাটি আরও একটি বিশেষ পতাকা, যা অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। অস্ট্রেলিয়া, মূলত একটি মহাদেশ হলেও, এর আশপাশে রয়েছে অনেক দ্বীপ, যার মধ্যে তাসমানিয়া অন্যতম। তাসমানিয়া, যে দ্বীপের রাজধানী হোবার্ট এবং যেখানে বেশ কিছু বড় ক্রিকেট ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ব্যাপকভাবে এই পতাকা ব্যবহৃত হয়। দ্বীপবাসীদের অবদানকে সম্মান জানাতে এই পতাকাটি তৈরি করা হয়েছে, যাতে তাদের ভূমি এবং জীবিকা যেভাবে অস্ট্রেলিয়ার অগ্রগতি ও বিকাশে অবদান রেখেছে, তা চিহ্নিত করা যায়। পতাকার ওপর এবং নিচে দুটি সবুজ প্যানেল রয়েছে, যা দ্বীপবাসীদের ভূমির অস্তিত্ব এবং তাদের ভূমির সঙ্গে সম্পর্ককে তুলে ধরে। মাঝখানে নীল চেম্বারটি সমুদ্রের গভীরতা এবং জলরাশির প্রতীক, এবং কালো দুটি রেখা দ্বীপবাসী জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। তার সঙ্গে একটি সাদা ধারি (যা নাচের পোশাকের মাথার আবরণ বা ঐতিহ্যবাহী কিছু প্রতীককে নির্দেশ করে) এবং পাঁচ কোণ বিশিষ্ট নক্ষত্রটি সমুদ্রের পথনির্দেশক নৌযানকে প্রতিফলিত করে।
এই তিনটি পতাকা অস্ট্রেলিয়ার মূল সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং জাতিগত বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। যেখানে প্রথম পতাকা ব্রিটিশ উপনিবেশের ইতিহাস এবং অস্ট্রেলিয়ার আধুনিক ঐতিহ্যকে সম্মান জানায়, দ্বিতীয় পতাকা আদিবাসী জনগণের দীর্ঘ ইতিহাস, সংগ্রাম এবং তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তুলে ধরে, এবং তৃতীয় পতাকা অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপবাসীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবদানকে চিহ্নিত করে।
এভাবে, অস্ট্রেলিয়া তার পতাকাগুলির মাধ্যমে শুধুমাত্র জাতীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয় নয়, বরং সকল জনগণের সমান অধিকার, সংগ্রাম এবং ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়েছে। তিনটি পতাকা উড়ানোর এই প্রথা অস্ট্রেলিয়ার গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বহুবিধ জনগণের মধ্যে সংহতি এবং সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।